প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আবির্ভূত হন কল্লোল যুগে। উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজর অমর সাহিত্য সৃষ্টি তাকে আকাশচুম্বী খ্যাতি এনে দিয়েছে। তিনি সমসাময়িক লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র। সাবলীল ভাষা শব্দ ব্যবহারে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি জীবন ও সমাজ জীবনের অবক্ষয় তার সাহিত্যে অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষার মাধ্যমে মনোজাগতিকতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সাহিত্য রচনায় ব্যাপৃত হয়েছেন।
তিনি নতুন ধারার সাহিত্য রচনায় প্রত্যয়ী ছিলেন। গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রেম, মনোভঙ্গি, হৃদয়বৃত্তি, দহন তার সাহিত্যে ক্রিয়াশীল। তার গল্প উপন্যাসে মানুষের যাপিত জীবনের গল্প সমাজের চিত্র নানাভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের মনের পীড়ন ভাঙন অসহায়ত্ব, চিত্তের আলোড়ন তার সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। মানুষের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, জীবন সংগ্রাম, বঞ্চনার গল্পগাঁথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষতার সঙ্গে তার গল্প উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। মানুষের দুঃখ কষ্ট প্রেম বিরহ আনন্দ বেদনা তার সাহিত্যে একীভূত হয়েছে। তিনি নর-নারীর সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার অনবদ্য সৃষ্টি তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
তিনি ধ্রুপদি ধারার রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র রচয়িতা। এ উপন্যাসটি ১৯৩৪ সালে ধারাবাহিকভাবে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এবং গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। ধ্রুপদি আঙ্গিকের এই উপন্যাসটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। পদ্মা নদীর মাঝিতে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন কাহিনী বিস্তৃতভাবে বিবৃত হয়েছে।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ রচনার মাধ্যম্যে ধ্রুপদিধারার আরও একটি শিল্পসফল উপন্যাস আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। এবং তিনি হয়ে উঠেছেন গৌরবের অংশীদার।
পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা এই দুই প্রভাবশালী উপন্যাসে মানিকের প্রতিভা সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে। এই দুইটি উপন্যাস তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের জীবন যাপনের বিচিত্র বোধকে স্বকীয়তায় ধারণ করেছেন। মানবকল্যাণমুখী চিন্তা ভাবনা বহুল প্রশংসিত এ উপন্যাসে প্রযুক্ত হয়েছে যা পাঠককে উদ্দীপ্ত করে। এই উপন্যাস পাঠ করলে মনে হয় জনকল্যাণ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য মানিক সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন। পুতুল নাচের ইতিকথায় সমাজ চিন্তক একজন লেখকের চিন্তা ভাবনার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়।
মানুষের নানা সংকট, দুঃখকষ্টকে তিনি প্রতিপাদ্য করেছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের বহুমাত্রিকতায় উদ্ভাসিত এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শশী একজন কল্পনা বিলাসী চিকিৎসক। বয়সে তরুণ তিনি। সদ্য ডাক্তারি পাস করে উন্নত জীবনের সন্ধানে সে কাজ করে। বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তার কষ্ট হয়। গ্রামে লাইব্রেরি না থাকায় তার কষ্ট বেড়ে যায়। কালো ও লম্বা চেহারার কুমুদ প্রচ- বেপরোয়া ও খ্যাপাটে স্বভাবের মানুষ। কুমুদ ও শশীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। কুমুদের বন্ধুত্বের সঙ্গ শশীকে দম বন্ধ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি দেয়।
কিন্তু কুমুদের এমন স্বভাব মতিকে প্রীতির তন্তু জালে আটকে দেয়। কুমুদের প্রতি অনুরক্ত মতি গাওদিয়া ছেড়ে কুমুদের সঙ্গে চলে যায়। শশীর সঙ্গে কুসুমের সম্পর্ক ভিন্নতা পায়। শশী কুসুমকে যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়। অবহেলিত হয় কুসুম। এ উপন্যাসে বিন্দু নামের চরিত্রটি তুমুল আকর্ষণ তৈরি করেছে। নন্দ লালের রক্ষিতা ছিল বিন্দু। সে স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি। শশীর জীবন ঘিরে যেসব নারী ছিল তারা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় একে একে। দেড় হাজার বছর পূর্বে বিক্রমপুর জনপদে বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয়। বিত্ত বৈভব সংস্কৃতির অমল আলোয় বিক্রমপুর বিকশিত।
বিক্রমপুর রাজধানী হিসাবে বিপুল সম্ভাবনা লালন করেছে। পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিক্রমপুর গাওদিয়া গ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামার বাড়ি ছিল বিক্রমপুর। সে কারণে বিক্রমপুরের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিক্রমপুর নদী মাতৃক। এই জনপদের মানুষেরা অত্যন্ত সংগ্রামী। প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয়। পদ্মার রূপ কখনো শান্ত কখনো রুদ্র। এরকম ধারায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন তাদের সুকুমাবৃত্তি প্রবাহিত হয়। এ সবকিছু মানিকের চিত্তে আলোড়ন তোলে।
গাওদিয়া গ্রাম পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের কারণে বিলীন হয়ে যাওয়া গাওদিয়া গ্রাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এ উপন্যাসে গাওদিয়া গ্রামের প্রকৃতির লীলায়িত সৌন্দর্য নদী পাড়ের মানুষের বিচিত্র বোধকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ধারণ করেছেন। রহস্যময়তা ও রূপকল্পের মাধ্যমে কুমুদ, মতি, যামিনী কবিরাজ, সেনদিদির চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ উপন্যাস বহমাত্রিকতায় উদ্ভাসিত। প্রকৃতির অবারিত রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা তিনি নিখুঁতভাবে দিয়েছেন। তালবন, অরণ্যানী, বৃক্ষের শনশন শব্দ তিনি কাব্যিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।
একজন নারীর আত্মদহন নিজেকে কিভাবে আবিষ্কার করে তা উপলব্ধি করা যায় কুসুমের উচ্চারণ থেকে ‘কি করে বুঝবেন মেয়ে মানুষের কত কি হয়। সব বোঝা যায় না। হলেনই বা ডাক্তার, এতো জ্বর জ্বালা নয়,। দশ বছর খেলা করেও সাধ মেটেনি। আমরা মুখ্য গেয়ো মেয়ে এসব খেলার মর্ম তো বুঝি না।’ কুসুম খুব চেনা, অতিশয় পরিচিত চরিত্রের নাম। সে অসংখ্য মানুষের প্রতিনিধি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে সহজবোধ্য ও জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন যা পাঠকদের মনোজাগতিক সত্তাকে সহজেই স্পর্শ করে। ভালোবাসা সমাজ সংসারের প্রয়োজনীয় উপদান হিসাবে এ উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যদিয়ে মানুষের জটিল সামাজিক সম্পর্ক, মনস্তত্ত্ব ও জীবনের কথকতা ও নানা চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে।
মানুষের জটিলতা দুর্বোধ্যতা, ব্যক্তির কপটতা, ক্রুরতা হিংস্রতার বিস্তারের পাশাপাশি মানুষের সরলতা আন্তরিকতা উপস্থাপিত হয়েছে। এ উপন্যাসে গাওদিয়া গ্রামের দৃশ্যপটে মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন আমরা প্রত্যক্ষ করি। বিচিত্র বোধ ও বহুমাত্রিক আকাক্সক্ষা, জীবনের আনন্দ বেদনার বিভিন্ন ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য়। মানুষের নানা স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে যথার্থভাবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চরিত্রায়নে অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সমাজ চিন্তা ও দার্শনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এ উপন্যাসের কাহিনী বিস্তারে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসটিকে জীবন ঘনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে মানব মানবীর জৈবিক কামনাকে প্রতিপাদ্য করেছেন। রাজকুমারের জীবন ঘিরে চারজন নারী গিরি, মালতি, সরসী, রিনির প্রেমের সম্পর্ককে এ উপন্যাসের কাহিনীর সঙ্গে মানিক গভীর মমতায় যুক্ত করেছেন। মালতীর প্রেমে রাজকুমার আটকে থাকতে পারেনি। মালতী কাম বাসনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে, শরীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু রাজকুমার নিজেকে মালতীর কাছে সমর্পণ করে না। সরে যায়। শারীরিক সান্নিধ্য আর মানসিক নৈকট্যের ভিন্নতা রাজকুমার সহজেই উপলব্ধি করতে পারে।
রাজকুমারের আসক্তি নারীর অনাচ্ছাদিত শরীরের শোভা দেখা। বাথরুমে রিনিকে দেখার অতিশয় আগ্রহ রাজকুমারের। রিনি রাজকুমারকে প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে সরসী যখন রাজকুমারের সামনে নিজেকে উন্মোচিত করে তখন রাজকুমার কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে রাজকুমার অনুৎসাহ বোধ করে। তুমুল মানসিক বৈকল্য তাকে নিষ্পৃহ করে দেয়।
সুনীল ‘পাশাপাশি’ উপন্যাসের নায়ক। তাকে প্রত্যহ রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। ভাগ্যে প্রতিদিন তাকে সাংসারিক চাহিদা মেটানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। সে টিউশনির পাশাপাশি টাইপরাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি অন্যদের শিখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। মায়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও মনের গভীরে শিহরণ জাগানিয়ার মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয় না।
নন্দার সঙ্গে সুনীলের পরিচয় হয় টিউশনি সূত্রে। এ উপন্যাসের অনেক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন দেখা যায়। দেশভাগ একটি ভৌগোলিক সীমা চিহ্নিত করলেও কোনো মুক্তি দেয়নি, সুনীলের এমনই উপলব্ধি।
সমাজ চিন্তক ও দার্শনিক লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য পাঠ আমদের সম্মোহিত করে। তার সাহিত্য কীর্তি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি একজন অনুসরণীয় সাহিত্যিক এ কথা স্বীকার করতেই হবে।